বিদায় হজ্জ

বিদায় হজ্জ – বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ    

দশম হিজরিতে রাসুল (সাঃ) লক্ষাধিক সাহাবীকে নিয়ে পবিত্র হজ্জ আদায় করেন । হজ্জের দ্বিতীয় দিন আরাফাত ময়দানে জাবাল – এ – রহমতে দাঁড়িয়ে তিনি উপস্থিত সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে এক হৃদয়স্পর্শী ভাষণ প্রদান করেন । মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবিতকালে এটাই ছিল তাঁর শেষ ভাষণ । ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ্জের এ ভাষণ বিদায় খুৎবা বলেও আখ্যায়িত । ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে ছিল চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা । ইসলাম ধর্ম পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে যে পূর্ণতা পেয়েছিল বিদায় হজ্জের ভাষণে ছিলো তারই চূড়ান্ত ঘোষণা । ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিল এভাষণে । ঐতিহাসিক এই ভাষণ কেবল ধর্মীয় অনুশাসনই ছিল না , বরং এতে ছিল  মানবসমাজের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ ।  আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি , মানবজাতির ঐক্য , ভ্রাতৃত্ব , সামাজিক বিধি বিধান , গণতান্ত্রিক সাম্য তথা সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল এই ভাষণে । এর মধ্য দিয়ে মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল যা সেদিন ভাষণ প্রদানকালে সূরা মায়িদাহ’র ৩ নং আয়াতে অবতীর্ণ হয়েছিল ।

উপস্থিত জনমণ্ডলী ! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন । হয়তো আমি আর কখনো এখানে তোমাদের সাথে একত্রিত হতে পারবো না ।

আজকের এই দিন ( জুমার দিন ) , এই স্থান ( মক্কা) , এই মাস ( জিলহজ মাস ) যেমন পবিত্র , তেমনি তোমাদের পরস্পরের জানমাল , ইজ্জত – আব্রু , মান – সম্মান কিয়ামত পর্যন্ত এমনই পবিত্র ।   

তোমাদের গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ্‌ তায়ালাকে ভয় কর ।  অধিনস্থদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে । তোমরা যা খাবে , তাদেরও তা খাওয়াবে । তোমারা যা পরবে তাদেরও তাই পরতে দেবে ।     

তোমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করবে না , নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না ।

একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেবে না । ঋণ পরিশোধ করবে ।  

সকল প্রকার সুদ রহিত করা হলো । সকল সুদের পাওনা বাতিল করা হলো । তোমাদের কেবল মূলধনের ওপর অধিকার রইল ।

তোমাদের নিজ স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে , তদ্রূপ তাদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে । তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয় । যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তোমাদের তাদের প্রতি কঠোরতা করার অনুমতি দিয়েছেন । এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে এবং মৃদু প্রহার করবে । তবে তাদের চেহারায় আঘাত করবে না । তাতে তারা বিরত হলে নিয়ম মাফিক তাদের ভরণ-পোষণের প্রতি লক্ষ্য রাখবে । স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে । তারা তোমাদের সাহায্যকারিনী । তোমরা তাদের আল্লাহ্‌র নির্ধারিত কালিমা বাক্যের মাধ্যমে নিজেদের জন্য হালাল করেছো । সুতরাং তাদের ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তায়ালাকে ভয় করো ।

তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে । যেনে রেখো , তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবাড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে ( কোন বিধর্মীকে জোর করে ইসলামে দীক্ষা দেয়া যাবে না । )এক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই ।

তোমরা আমীর বা নেতার আনুগত্য করো এবং তাঁর কথা শ্রবণ করো যদিও তিনি হন হাবশি ক্রীতদাস । যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহ্‌র কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন , ততদিন অবশ্যই তোমরা তাঁর কথা শুনবে , তাঁর নির্দেশ মানবে ও তাঁর প্রতি আনুগত্য করবে । আর যখন তিনি আল্লাহ্‌র কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবে , তখন থেকে তাঁর কথাও শুনবে না এবং তাঁর আনুগত্যও করা যাবে না ।

সকল মুমিন পরস্পর ভাই ভাই । আর তারা সকলে মিলে এক অখণ্ড মুসলিম ভ্রাতৃ সমাজ ।

কারো জন্য অন্যের সম্পদ বৈধ নয় । তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয় , তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার ।

আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেও না । পরস্পর খুনাখুনি করো না ।

অন্ধকার যুগের সকল কৌলীন্য বিলুপ্ত করা হলো । জাহেলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো ।

কারো কাছে যদি কোন আমানত রক্ষিত থকে , তাহলে সে যেন তা আমানতকারীর নিকট পৌঁছে দেয় । আমানতের খিয়ানত করবে না ।   

গুনার কাজ থেকে বিরত থাকবে । মনে রাখবে একদিন সকলকে আল্লাহ্‌র সামনে উপস্থিত হতে হবে ও তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে ।

তোমরা আল্লাহ্‌র বন্দেগী করবে , দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে । রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে । যাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবে । তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে ।

আমি আখেরি নবী । আমার পরে আর কোন নবী আসবে না । আমার সাথে ওহীর পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে । হে মানুষেরা ! আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ । আমাকেও আল্লাহ্‌ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে ।

আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে গেলাম , তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে কখনো বিভ্রান্ত হবে না । তা হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী ( আল কুরআন ) ও তাঁর রাসুলের আদর্শ ( হাদিস ) ।  

তোমাদের প্রভু একজন । তোমাদের পিতাও (আদম ) একজন । তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি ।

তোমাদের মাঝে যারা সর্বাধিক মুত্তাকি , খোদাভীরু তারাই আল্লাহ্‌র কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান । তাকওয়া ছাড়া কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই । সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোন মর্যাদা নেই । তাকওয়াই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে ।

হে মানুষগণ ! শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে । বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না । তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সতর্ক থাকবে ও তার অনুসারী হবে না ।

আল্লাহ্‌ তায়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন । উত্তরাধিকারীর জন্য কোন ওসিয়ত প্রযোজ্য নয় । অন্যদের জন্য এক – তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত করা বৈধ নয় ।

আমাদের কিয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসা করা হবে । তোমাদেরও জিজ্ঞাসা করা হবে । তখন তোমারা আমার ব্যাপারে কি বলবে ? আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ্‌র বানী যথাযথভাবে  পৌঁছাতে পেরেছি ? উপস্থিত জনতা উত্তর দিলেন , হ্যাঁ নিশ্চয়ই ।  আমরা  সাক্ষ্য দেব যে , আপনি আপনার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন । হিত কামনা করেছেন । অতঃপর রাসুল (সাঃ) আকাশের দিকে হাত তুলে তিনবার বললেন , আল্লাহ্‌ আপনি সাক্ষী থাকুন । তারপর বললেন , তোমরা এখানে যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার এ পয়গাম পৌঁছে দেবে । হয়ত তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের উপর তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে । “তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক , বিদায়” ।

এরপর অবতীর্ণ হলো , “ আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম । ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম । ( সূরাঃ আল – মাদিয়া , আয়াতঃ ৩ )

বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর মহানবী (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন । অবশেষে একাদশ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল রাসুল (সাঃ) ইন্তেকাল করেন ।

tor-e-tokka.com# h/@ hasneaimun

ছবিঃ সংগ্রহ

আরও খবর