প্যালিনড্রোম

বিরল প্যালিনড্রোম বা দ্বিমুখী তারিখ ০২/০২/২০২০

প্রায় নয়শত বছর পর বিরল প্যালিনড্রোম বা দ্বিমুখী তারিখ দেখল বিশ্ববাসী। ২ ফেব্রুয়ারি ( ০২/০২/২০২০ ) তারিখটি ছিল অন্তর্জাতিক প্যালিনড্রোম।

২ ফেব্রুয়ারি তারিখটি মাস / দিন / বছর বা দিন / মাস / বছর যেভাবেই লেখা হোক না কেন এটি কার্যকর হয় যেকোনো বিপরীত দিক থেকে। এই জাতীয় তারিখগুলোকে ‘সর্বব্যাপী প্যালিনড্রোমস’ বলে। এমন আরেকটি প্যালিনড্রোম পেতে অপেক্ষা করতে হবে এক শতাব্দীরও বেশি সময়। অর্থাৎ ১০১ বছর পর দেখা মিলবে ৩ মার্চ, ৩০৩০ (০৩ ০৩ ৩০৩০)। এই জাতীয় প্যালিনড্রোমের শেষ তারিখটি ছিল ১১-১১-১১১১। যেটি ঘটে ছিল ৯০০ বছর আগে।

প্যালিনড্রোম ( Palindrome) হল এমন কিছু বিশেষ শব্দ আর সংখ্যা যার আরম্ভ বা শেষ দুদিক থেকেই পড়লে শব্দের উচ্চারণ আর অর্থের কোন বদল হয় না বা সংখ্যার মান একই থাকে (সংখ্যার ক্ষেত্রে)। মূল গ্রীক শব্দ প্যালিনড্রোমাস(অর্থ: Running back again) থেকে ইংরেজি প্যালিনড্রোম শব্দটি এসেছে। বাংলা ভাষায় একে দ্বিমুখী শব্দ বা সংখ্যা বলা যায়। এধরনের দ্বিমুখী শব্দ বা বাক্য সাজাতে যারা দক্ষ তাঁদের ‘পেলিনড্রোমিস্ট’ বলা হয়। প্যালিনড্রোমিক লেখা প্রাচীন ‘কিরাতার্জুনীয়’ কাব্যের বহু অনুচ্ছেদে দেখা যায়। এমনই একটি অনুচ্ছেদ হল- “সারস নয়না ঘন অঘ নারচিত রতার কলিক হর সার রসাসার রসাহর কলিকর তারত চিরনাঘ অনঘ নায়ন সরসা”।

চতুর্দশ শতকে দৈবজ্ঞ সূর্য পণ্ডিতের লেখা ‘রামকৃষ্ণ বিলোম কাব্যম’ নামে ৪০টি শ্লোকের যে বিখ্যাত কবিতা রয়েছে তার রচনাশৈলীও ভারি অদ্ভুত। প্রতিটি শ্লোকই এক-একটি প্যালিনড্রোম। আবার কবিতাটি সামনে থেকে পড়লে রাম ও রামায়ণের কাহিনি আর পেছন থেকে পড়লে কৃষ্ণ ও মহাভারতের কাহিনি।

বাংলায় প্যালিনড্রোমিক শব্দ অনেক থাকলেও প্যালিনড্রোমিক বাক্য খুব বিরল। কারণ বাংলায় যুক্তবর্ণ ও যুক্তাক্ষরের ব্যবহার হয়। প্যালিনড্রোমিক শব্দের মধ্যে বহুশ্রুত দুই অক্ষরের শব্দ হল- বাবা, দাদা, মামা, কাকা, চাচা, নানা, লালা, চিঁচিঁ, হিহি, জুজু ইত্যাদি।

তিন অক্ষরের প্যালিনড্রোমিক শব্দের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, যেমন- মরম, মলম, দরদ, জলজ, তফাত, মধ্যম, বাহবা, চামচা, সন্ন্যাস, সন্ত্রাস, সরেস, সমাস, সহিস, নতুন, নরুন, নরেন, নন্দন, নবীন, কালিকা ইত্যাদি।

একটু বড় প্যালিনড্রোমিক শব্দ হল বনমানব, নবজীবন। প্যালিনড্রোমিক নামও বাংলায় আছে বেশ কিছু – মহিম, নরেন, নটেন, কনক, কটক ইত্যাদি। তবে রমাকান্ত কামার ছাড়াও সুবললাল বসু, সদানন দাস, রায়মনি ময়রা, হারান রাহা, নিধুরাম রাধুনি, দেবী দে ইত্যাদি পদবিসহ প্যালিনড্রোমিক নাম।

বাংলায় অর্থপূর্ণ প্যালিনড্রোমিক বাক্য গঠন করা বেশ কষ্টসাধ্য। তবুও সরল কিছু শব্দ সহযোগে ছোট ছোটো প্যালিনড্রোমিক বাক্য গঠন করা যায়। বই চাইব, তুমি কি মিতু, বিকল্প কবি, ঘুরবে রঘু, সীমার মাসী, ইভার ভাই, নাম লেখালেম না ইত্যাদি হলো প্রচলিত প্যালিনড্রোমিক ছোট্টো বাক্য।

অবশ্য গণিতে প্যালিনড্রোমিক সংখ্যার অভাব নেই। সাধারণভাবে যে কেউ হাজার হাজার প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা তৈরি করতে পারে যেমন ১১, ২২, ১২১, ২৩২, ২৪৪২, ১২৩২১ ইত্যাদি।

তবে সহজ অ্যালগোরিদম পদ্ধতিতে (নির্দেশমত সুনির্দিষ্ট ধাপে) যে কোনও অ-প্যালিনড্রোমিক সংখ্যাকে প্যালিনড্রোমিক সংখ্যায় পরিণত করা যায়। যেমন একটি সংখ্যা হল ৫৭ (দুই, তিন, চার বা তার বেশি অঙ্কের সংখ্যা ধরা যেতে পারে)। এবার সংখ্যাটিকে উল্টে দেওয়া হল। তাহলে সংখ্যাটি হল ৭৫। এবার এই দুটি সংখ্যা যোগ করা হল। তাহলে এবার সংখ্যাটি হল (৫৭+৭৫)=১৩২। একেও উল্টে দেওয়া হল। তাহলে সংখ্যাটি হল ২৩১। আবার এই দুটো সংখ্যা যোগ করা হল। যোগফল হল (১৩২+২৩১)=৩৬৩। এটি একটি প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা।

তিন অঙ্কের সংখ্যা, ধরা যাক সংখ্যাটি ২৫৫। একই নিয়মে ২৫৫+৫৫২=৮০৭, ৮০৭+৭০৮=১৫১৫, ১৫১৫+৫১৫১=৬৬৬৬। তিন ধাপেই পাওয়া গেল প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা। এভাবেই যে কোনও সংখ্যাকেই এই নিয়মে পর পর যোগ করে গেলে একসময় প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা চলে আসবে। তবে এ যাবৎ সবচেয়ে দেরিতে যে সংখ্যাটির প্যালিনড্রোম তৈরি করা গেছে এই নিয়মে তা হল ১,১৮৬,০৬০,৩০৭,৮৯১,৯২৯,৯৯০ । ২৬১ ধাপের পর এটি প্যালিনড্রোমে পরিণত হয়।

পাশাপাশি অঙ্কে প্যালিনড্রোমিক-মজার দৃষ্টান্তও প্রচুর। যেমন- ৯ সংখ্যাটির প্যালিনড্রোম জাদু। ৯-এর সব গুণিতককে (যেমন ০,৯,১৮,২৭,…. ৯০) পর পর পাশাপাশি লিখলে তা কিন্তু লম্বা একটা প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা হয়ে যাবে। সংখ্যাটি হল- ০৯১৮২৭৩৬৪৫৫৪৬৩৭২৮১৯০ । আবার ১ সংখ্যাটিরও আছে প্যালিনড্রোমিক ম্যাজিক। ১ দিয়ে তৈরি সমসংখ্যক অঙ্কের দুটি সংখ্যার গুণফল সবসময় প্যালিনড্রোমিক হবে। যেমন- ১১x১১=১২১, ১১১x১১১=১২৩২১, ১১১১x১১১১=১২৩৪৩২১, ১১১১১x১১১১১=১২৩৪৫৪৩২১ ইত্যাদি।

বেশ কিছু মৌলিক সংখ্যা আছে যেগুলো প্যালিনড্রোম। তিন অঙ্কের সংখ্যার মধ্যে রয়েছে ১৫টি সংখ্যা, যেমন ১০১, ১৩১, ১৫১, ১৮১, ১৯১, ৩১৩, ৩৫৩, ৩৭৩, ৩৮৩, ৭২৭, ৭৫৭, ৭৮৭, ৭৯৭, ৯১৯, ৯২৯। আবার পাঁচ অঙ্কের সংখ্যার মধ্যে রয়েছে ৯৩টি মৌলিক সংখ্যা। সাত অঙ্কের সংখ্যার মধ্যে রয়েছে ৬৬৮টি। দুটি ক্রমিক সংখ্যার গুণফলের ক্ষেত্রে প্যালিনড্রোম সংখ্যা তৈরি হয় পাঁচটি ক্ষেত্রে। যেমন ১৬x১৭=২৭২, ৭৭x৭৮=৬০০৬, ৫৩৮x৫৩৯=২৮৯৯৮২, ১৬২১x১৬২২=২৬২৯২৬২, ২৪৫৭x২৪৫৮=৬০৩৯৩০৬। তিনটি ক্রমিক সংখ্যার গুণফলের ক্ষেত্রে প্যালিনড্রোম হয় মাত্র একটি ক্ষেত্রে, ৭৭x৭৮x৭৯=৪৭৪৪৭৪ । আবার প্যালিনড্রোমে বিন্যস্ত দুটি সংখ্যার গুণফল হয় প্যালিনড্রোমে বিন্যস্ত অপর দুটি সংখ্যার গুণফল। নমুনা দেওয়া হলো – ১৪৪x৪৪১=২৫২x২৫২, ১২২৪x৪২২১=২১৪২x২৪১২, ১৩৩৪৪x৪৪৩৩১=২৩৩৫২x২৫৩৩২ ইত্যাদি।

গত শতাব্দীর একমাত্র প্যালিনড্রোমিক বছর ছিল ১৯৯১ সাল। একবিংশ শতাব্দীতে ফেলে আসা ২০০২ সালটিই হল একমাত্র প্যালিনড্রোমিক সাল। আর পরের শতাব্দীতে ২১১২ হবে প্যালিনড্রোমিক বছর। আবার দিন, মাস ও সাল ধরে আট সংখ্যার তারিখ খুঁজে দেখলে বর্তমান শতাব্দীতে কুড়িটি প্যালিনড্রোমিক তারিখ পাওয়া যাবে, যেমন প্রথমটি ছিল ১০.০২.২০০১। তারপর চলে গেছে ২০.০২.২০০২, ১১.০২.২০১১ ও ২১.০২.২০১২। আগামীতে আসবে – ১২.০২.২০২১, ২২.০২.২০২২, ১৩.০২.২০৩১, ২৩.০২.২০৩২, ১৪.০২.২০৪১, ২৪.০২.২০৪২, ১৫.০২.২০৫১, ২৫.০২.২০৫২, ১৬.০২.২০৬১, ২৬.০২.২০৬২, ১৭.০২.২০৭১, ২৭.০২.২০৭২, ১৮.০২.২০৮১, ২৮.০২.২০৮২, ১৯.০২.২০৯১ এবং ২৯.০২.২০৯২।

ছবিঃ সংগ্রহ

আরও খবর